আধুনিক ইস্তাম্বুলের অন্যতম দর্শনীয় স্থান গ্রেট চামলিজা মসজিদ। সাত পাহাড়ের শহর ইস্তাম্বুলের সর্বোচ্চ পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই মসজিদ তুরস্কের সবচেয়ে বড় জামে মসজিদ। ইস্তাম্বুলের যে কোন প্রান্ত থেকে দেখা যায় এই মসজিদ। মসজিদের প্রশস্ত আঙ্গিনা থেকে দেখা যায় নয়নাভিরাম ইস্তাম্বুল ও বসফরাসের ব্যস্ত নৌপথ।
মসজিদের শহর ইস্তাম্বুলে প্রতিটি সুলতান, যুবরাজ, রাজমাতা, উজির, নাজির অনেকেই নিজের নামে মসজিদ তৈরী করে গেছেন। এভাবে এক কালের খ্রীস্টান পৃথিবীর পরাশক্তি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল তিলে তিলে পরিবর্তন হয়ে ইসলামী সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। ১৪৫৩ পরবর্তী ৫৫০ বছর মুসলমানরা দরদ আর ভালবাসা দিয়ে সাজিয়েছে এই শহরকে। ইস্তাম্বুলের একেকটি মসজিদ যেন একেকটি মাস্টারপিস। যেমন তার সৌন্দর্য তেমনি মসজিদগুলোয় রয়েছে মানবকল্যাণের নানা আয়োজন।
আধুনিক সেক্যুলার তুরস্কের প্রথম ইসলামপন্থী মেয়র রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি মেয়র হয়ে ইস্তাম্বুলের ইসলামি পরিচয়কে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করেন। তার একটি স্বপ্ন ছিল তুরস্কের সবচেয়ে বড় মসজিদটি তিনি করে যাবেন ইস্তাম্বুলে। প্রধানমন্ত্রী হয়ে এরদোয়ান অনেকগুলো প্রায় অসম্ভব মনে হওয়া মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেছেন। যেমন বসফরাস প্রণালীর নিচ দিয়ে রেল ও সড়ক টানেল, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর, চানাক্কালে প্রণালীর উপর ঝুলন্ত সেতু, হাইস্পিড ট্রেন। ২০০০ সালের দিক থেকে তিনি ইস্তাম্বুলে একটি বড় মসজিদ কমপ্লেক্স করার স্বপ্নের কথা বলে আসছেন।
অবশেষে এই স্বপ্ন সত্যি হয় ২০১৯ সালে। পৃথিবীর সেরা ডিজাইনারদের দিয়ে প্রতিযোগিতা করিয়ে একটি ডিজাইন বাছাই করা হয়। শুরু থেকে নানা বাহানায় এই মসজিদের বিরোধিতা করে আসছিল সেক্যুলার বিরোধীদল। একরোখা এরদোয়ান সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রকাণ্ড এই মসজিদের নির্মাণ কাজ সফল ভাবে শেষ করেন। মসজিদটিতে একসাথে ৬৩ হাজার মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। জরুরী অবস্থায় আশ্রয় নিতে পারবে ১ লাখ মানুষ। মসজিদে কমপ্লেক্সে রয়েছে বিশাল একটি লাইব্রেরী, আর্ট গ্যালারী, শিশু পার্ক এবং কনফারেন্স রুম। এছাড়া ২০২২ সালে এই মসজিদে মিউজিয়াম অব ইসলামিক সিভিলাইজেশন নামে একটি জাদুঘর সংযুক্ত করা হয়েছে।
মসজিদের মুল গম্বুজ ৭২ মিটার উচ্চতার। এখানে ইস্তাম্বুলের বসবাস করা ৭২ জাতিগোষ্ঠীর কথা ফুটিয়ে তুলা হয়েছে। গম্বুজের মধ্যে এমন ভাবে নীল নকশা করা কাঁচের স্থাপন করা হয়েছে যেন মসজিদের ভেতর সবসময় একটি প্রাকৃতিক নীল আলোর আভা ছড়িয়ে থাকে। নীলাভ আলোয় স্নিগ্ধ এক ইবাদতের পরিবেশ তৈরী হয় দিনের বেলায়। রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোকসজ্জায় সাজানো হয় মসজিদ। মসজিদের বাইরে এমনভাবে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যে রাতের ইস্তাম্বুলের যে কোন স্থান থেকেই নজর কাড়বে পাহাড় চূড়ার এই প্রকাণ্ড মসজিদ।
৬ টি মিনার রয়েছে এই মসজিদে। চামলিজা মসজিদের মিনারের উচ্চতা ১০৭.১ মিটার। এখানে একটি রহস্য আছে। এখানে নোকতা ছাড়া পড়লে দেখবেন ১০৭১। এটি একটি ঐতিহাসিক সংখ্যা। ১০৭১ সালে পূর্ব তুরস্কের ভান লেকের পারে ঐতিহাসিক মালাজগির্ট যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে সেলজুক তুর্কি মুসলমানদের কাছে হেরে যায় বাইজেন্টাইন সম্রাটের বাহিনী। এভাবে তুর্কি মুসলমানদের আনাতোলিয়ার মূল ভূখন্ডে প্রবেশের সুযোগ হয়। ইসলামের এই বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতেই এই মসজিদের মিনারকে ১০৭.১ মিটার উচ্চতার করা হয়েছে। মসজিদের কনফারেন্স রুমেও ১০৭১ টি আসন রয়েছে।
ওসমানী গ্রেট আর্কিটেক্ট মিমার সিনানের ডিজাইনকে অনুপ্রেরণা ধরে এই মসজিদের ডিজাইন করেছেন দুই নারী আর্কিটেক্ট। তারা এই মসজিদটিকে নারীবান্ধব মসজিদে রুপ দিয়েছেন। মসজিদের মুল নামাজ রুমে ৬০০ মহিলার নামাজের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। নারীদের জন্য এই মসজিদের আলাদা অজুখানা ও আলাদা লিফট রয়েছে। রয়েছে শিশু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা কক্ষ।
২০১৯ সালে এই মসজিদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন অনেক দেশের রাষ্ট্রপতি। ২০১৯ সালে ইন্তেকাল করেন প্রখ্যাত উসমানী ইতিহাসবিদ কাদির মিসিরঔলু। তাঁর জানাজায় হাজির হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রতিদিন দেশ বিদেশের অনেক মুসল্লি এই মসজিদের নামাজ পড়তে আসে। আসে বিদেশী অমুসলিম পর্যটকরাও। ইস্তাম্বুলের উসকুদার থেকে সহজে আসা যায় এখানে।
কালের আবর্তে একদিন হারিয়ে যাবে এরদোয়ানের শাসন, বিগত হয়ে যাবে এই সময়। শত বছর পরও রয়ে যাবে চামলিজা মসজিদ। ইস্তাম্বুলের উচ্চতম পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত চামলিজা মসজিদের ১০৭.১ মিটার উঁচু অভ্রভেদী মিনার থেকে বাতাসে ভেসে বেড়াবে সুমধুর আজান। আল্লাহু আকবর।