ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত আয়া সোফিয়া মসজিদের ঠিক পেছনেই অবস্থিত তোপকাপি প্রাসাদ। ওসমানী সাম্রাজ্যের ৬২৪ বছরের শাসনামলের ৪০০ বছরই রাজপ্রাসাদের মর্যাদা পেয়েছে এই প্রাসাদ। সুলতান ও তাঁর পরিবারের বাসভবন ছাড়াও এই প্রাসাদ ছিল ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এই প্রাসাদের ভেতরেই তৈরী হতো ওসমানী স্বর্ণমুদ্রা। ইমপেরিয়াল মিন্ট নামক এই ভবন থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তুরস্কের মুদ্রা/কয়েন তৈরী করা হতো।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন রাজপ্রাসাদগুলোর মধ্যে তোপকাপি প্রাসাদ এখনো তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে। ভারতের আগ্রার প্রাসাদ কিংবা দিল্লীর লালকেল্লার মতো কখনো লুটপাটের শিকার হয় নি। বলা হয়ে থাকে তোপকাপি প্রাসাদের তোহাখানায় এখনো যে পরিমান রাজকীয় রত্নপাথর ও মূল্যবান জিনিসপত্র আছে, তুরস্ক যদি কোনদিন দেউলিয়াও হয়ে যায় তা নিয়ে ৩ বছর তুরস্ক চালানো যাবে।
এই প্রাসাদের রয়েছে ওসমানী সুলতানের সিংহাসন, হারেমে রয়েছে হাজিনে বা রত্নভাণ্ডার। হাজিনেতে প্রদর্শন করা আছে মহামূল্যবান হিরা কাশিকচি এলমাছি বা স্পুন মেকারর ডায়মন্ড। আছে সোনায় মোড়ানো মহামুল্যবান তোপকাপি খঞ্জর।
এই প্রাসাদে রয়েছে আরেকটি অমূল্য সম্পদ। তাহলো ইসলামের দূর্লভ নিদর্শনসমূহের জাদুঘর। তোপকাপি প্রাসাদের ভেতরের সেই পবিত্র জাদুঘরে রয়েছে হযরত মুহাম্মদ (স) স্মৃতিবিজরিত অনেক স্মৃতি চিহ্ন, মূসা নবীর লাঠি ও দাউদ নবীর তলোয়ার, বিভিন্ন সাহাবীদের তলোয়ার সহ আরো অমূল্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীর ভিড় জমে এই জাদুঘরের প্রবেশপথে। লম্বা লাইন পার হয়ে প্রবেশ করতে হয় এখানে।
তোপকাপি প্রাসাদকে একটি প্রাসাদ বা ভবন না বলে একটি শহর বলা যেতে পারে। ৭ লক্ষ বর্গ মিটার এলাকার উপর নির্মিত এই প্রাসাদে ৫ হাজার মানুষ বাস করতো। উৎসব আয়োজনে তা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেত।
১৪৫৩ সালে ইস্তাম্বুল জয় করার পর বিজেতা সুলতান ফাতিহ সুলতান মেহমেতের নির্দেশে এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। তারপর থেকে ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত তোপকাপি ছিল ওসমানীদের মূল প্রশাসনিক কেন্দ্র। ১৮৫৩ সালে নতুন নির্মিত দোলমাবাহচে প্রাসাদে সুলতানের অফিস সরিয়ে নিলে গুরুত্ব কমে আসে তোপকাপির। তারপরও রাজপরিবারের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। ১৯২৪ সালে সালতানাত উৎখাত করে মোস্তাফা কামাল আতাতুর্ক এটিকে জাদুঘর ঘোষণা করে।
তোপকাপি প্রাসাদের অনেকগুলো অংশ আছে। প্রাসাদের একটি প্রশাসনিক অংশ, আরেকটি হারেম বা ফ্যামিলি কোয়ার্টার।
এছাড়া মূলত প্রাসাদ চারটি বড় কোর্টইয়ার্ড দ্বারা গঠিত। প্রথম কোর্ট ইয়ার্ডের নাম আলাই স্কয়ার এবং এটি সবচেয়ে বড়। দ্বিতীয় কোর্টইয়ার্ডের নাম দিওয়ান স্কয়ার। এটিকে ন্যায় বিচারের স্কয়ারও বলা হয়। এখনে অনেক ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তৃতীয় কোর্ট ইয়ার্ডের নাম এনদেরুন কোর্টইয়ার্ড এবং সর্বশেষ চতুর্থ কোর্টইয়ার্ড। এখানে বসফরাসমুখী অনেকগুলো প্যাভিলিয়ন ও বাগান রয়েছে যা একান্তই সুলতানের ব্যবহারে জন্য নিবেদিত ছিল।
এছাড়া তোপকাপি প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে কয়েকটি জাদুঘর। এগুলোতে ওসমানী আমলের সমরাস্ত্র, সিরামিক, পোশাক, ওসমানী দুর্লভ পান্ডুলিপি প্রদর্শন করা আছে।
প্রাসাদের এই সাইডে রয়েছে ইমপেরিয়াল হারেম। হারেমে প্রবেশ করতে প্রয়োজন আলাদা টিকেট। হারেম অংশে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল। হারাম বা নিষেধ শব্দ থেকে এসেছে হারেম। মুসলমান নারীরা যেহেতু পর্দা করতো তাই হারামে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল না। ফলে পশ্চিমা অনেক উৎসুক পর্যটক যাদের কখনো হারেমে প্রবেশের সুযোগ হয় নি, তারা হারেমকে নিয়ে অনেক কাল্পনিক ও অশ্লীল ছবি এঁকেছে। বাস্তবের সাথে তার কোন মিল নেই। হারেম ছিল সুলতানের পারিবারিক বাসস্থান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাসস্থান বলতে, এখানে বাস করতো সুলতান নিজে, তাঁর স্ত্রীরা, তাঁর ছোট শিশু সন্তানরা, সুলতানে মা, চাচী, সহ পরিবারের মুরব্বীরা। তাঁদের দেখাশুনা ও খেদমতের জন্য নিয়োজিত দাসীরা। এছাড়া পরবর্তী সুলতান ও সুলতানাদের যোগ্য করে তৈরী করার জন্য এখানে ছিল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যারা রাজপরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের বিশ্বশাসনের উপযোগী করে গড়ে তুলতো। তোপকাপি প্রাসাদের হারেমে শিক্ষা লাভ করার জন্য তৎকালীন পৃথিবীর অনেক রাজা বাদশাহরা তাঁদের সন্তানদের প্রেরণ করতো।
৭ লক্ষ বর্গ মিটারের প্রাসাদের মাত্র ৩ লক্ষ বর্গমিটার দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘর হিসেবে উন্মুক্ত। তবু তোপকাপি এতোটাই বড় যে একদিনে ঘুরে দেখা প্রায় অসম্ভব। আয়া সোফিয়ার সামনে থেকে শুরু করে প্রাসাদের শেষ অংশ অর্থাৎ বসফরাসের সামনে এসে পৌছাতে পৌছাতে সারা শরীরে অবসাদ নেমে আসে। কয়েকবার বিশ্রাম নিতে বাধ্য হয় পর্যটকরা।
৪০০ বছর ধরে তিন মহাদেশ শাসন করা পরাক্রমশালী সুলতানদের ধারণ করেছে এই প্রাসাদ। অনেক ঘটনা ও দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে। ইস্তাম্বুলে আসা যে কোন পর্যটকদের জন্য এক অবশ্যই দর্শনীয় স্থান তোপকাপি প্রাসাদ।