তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থাপনা সুলতান আহমেদ ব্লু মস্ক। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ নামক এলাকায় অবস্থিত এই প্রকাণ্ড মসজিদ। ৬ মিনারের মসজিদটি মর্মর সাগরের পাশেই। মসজিদের ঠিক বিপরীত পাশে রয়েছে বিখ্যাত আয়া সোফিয়া মসজিদ।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলর আইকনিক স্থাপনা ছিলো আয়া সোফিয়া চার্চ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীণ স্থাপনা এটি। এখানেই বাইজেন্টাইন সম্রাটের শপথ হতো। পরবর্তীতে ইসলামিক ইস্তাম্বুলের আইকন হয় মুসলমানদের নির্মিত সুলতান আহমেদ ব্লু মস্ক।
কিন্তু ১৪৫৩ সালে ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ ইস্তাম্বুল জয় করার পর আয়ো সোফিয়া খ্রীস্টানদের থেকে কিনে নেন। তারপর এটিকে মসজিদে রুপান্তরিত করেন। মসজিদের রুপান্তরের পর আয়া সোফিয়াকে আরো সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন করেন। পরবর্তী সুলতানরা আয়া সোফিয়ার পাশে নির্মান করেন দুটি মিনার। কিন্তু খ্রীস্টানরা মুসলমানদের বলত, তোমরা শক্তির জোরে আমাদের থেকে আয়া সোফিয়া নিয়েছে কিন্তু নিজেরা এরকম একটি আয়া সোফিয়া নির্মাণ করতে পারবে না।
খ্রীস্টানদের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেন ১৯ বছর বয়সী তরুন সুলতান আহমেদ। ১৬০৯ সালে তিনি আয়া সোফিয়ার চেয়ে বড় ও সুন্দর একটি মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন তিনি। তার নির্দেশে উসমানী ইমপেরিয়াল আর্কিটেক্ট সেদেফকার মোহাম্মদ আগা মসজিদের কাজ শুরু করেন।
সুলতান আহমেদ মসজিদে রয়েছে ৫ টি বড় গম্বুজ, ৮ টি ছোট গম্বুজ ও ৬ টি সুউচ্চ মিনার। কথিত আছে সুলতান নির্দেশ দিয়েছিলেন আলতিন মিনার বানাতে কিন্তু আর্কিটেক্ট শুনেছে আলতি মিনার। আলতিন মানে স্বর্ন, আর আলতি মানে ৬ টি। তাই ৬ টি মিনার বানানো হয়েছে। তৎকালীন সময় শুধু মক্কা শরীফের মসজিদে ৬ টি মিনার ছিলো। পরে ওসামানী সুলতানের নির্দেশে মক্কায় আরো একটি মিনার বানানো হয়। এভাবে মক্কার মর্যাদা সবচেয়ে ওপরে রাখে সুলতান।
এই মসজিদকে কেন ব্লু মসজিদ বলা হয়। কারন মসজিদের ভেতরে নীল রংয়ের ২০ হাজার টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। টাইলস নির্মাণে বিখ্যাত তুরস্কের ইজনিক শহর থেকে হাতে নির্মিত এই টাইলসগুলো সংগ্রহ করা হয়। টিউলিপ ফুলের ৬০ টি আলাদা ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেসব টাইলসে। এছাড়া প্রাকৃতিক আলো প্রবেশের জন্য মসজিদে রয়েছে ২৪০ টি জানালা। সেসব জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে লান, নীল, হলুদ সহ বিভিন্ন রংয়ের গ্লাস। ফলে রঙ্গিন আলো যখন নীল টাইলসের ভেতর পরে তখন এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
মসজিদটি নির্মাণের সময় একটি ছিলো একটি কুল্লিয়ে বা কমপ্লেক্স। এখানে একটি মাদ্রাসা, ১ টি হাসপাতাল, একটি মার্কেটও ছিলো। পরে সুলতানের পরিবারে সমাধিও নির্মাণ করা হয় মসজিদের সাথে।
এই মসজিদটি ছিলো সুলতান আহমেদের অনেক স্বপ্নের মসজিদ। মসজিদ নির্মাণের প্রথম দিন তিনি নিজে শ্রমিক হয়ে কাজ শুরু করেন। পরে রাজকীয় ব্যস্ততার মাঝেও প্রায়ই তিনি স্বশরীরে এসে নির্মাণ কাজের তদারকি করতেন। আধুনিক ক্রেন অথবা বর্তমানকালের আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই প্রকান্ড এই মসজিদের কাজ মাত্র ৭ বছরে শেষ হয়। তবে নিজের বানানো মসজিদের বেশী দিন নামাজ পড়তে পারেন নি সুলতান। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার মাত্র ১ বছর পর টাইফিস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন সুলতান। মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার কবরের সাথে রয়েছে তা স্ত্রী কোসেম সুলতান ও ৩ ছেলে, মেয়ে ও পরিবারের সদস্যদের কবর।
৪০০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তরুণ সুলতানের নির্মিত মসজিদটি আজো টিকে আছে। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক আসে মসজিদটি দেখতে। মসজিদের ভেতরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিনামূল্যে কোরআন ও ইসলামিক বই বিতরণ করা হয়। মসজিদের বাইরের কোর্টইয়ার্ডে ইসলামের বিভিন্ন নিয়মকানুন নিয়ে সচিত্র একটি গ্যালারী রয়েছে। ইস্তাম্বুলের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান সুলতান আহমেদ মসজিদ।