ইস্তাম্বুলের রাজপ্রাসাদ সমূহ: তোপকাপি থেকে বেইলারবেই

tog
istanbul-royal-palaces
Nov. 7, 2024

ইস্তাম্বুল ছিল ওসমানী সালতানাতের শেষ রাজধানী। ১২৯৯ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৬২৪ বছর বিশ্ব শাসনকারী প্রবল প্রতাপশালী এই রাজপরিবার ইস্তাম্বুল থেকেই তাঁদের শাসনকার্য পরিচালনা করেছে।

 

ওসমানীরা ইস্তাম্বুলকে সাজিয়েছিল বিশ্বের সুন্দরতম নিরাপদ শহর হিসেবে। তৈরী করেছিল অনেক সুরম্য প্রাসাদ। চোখ ধাঁধানো শান-শওকতের এই প্রাসাদগুলো যেন ছিল সুন্দরী ইস্তাম্বুলের অলংকার। আজকে আমরা ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত কিছু প্রাসাদ দিয়ে আলোচনা করবো।

 

. তোপকাপি প্রাসাদ

শুধু তুরস্ক নয়। বিশ্বের বৃহত্তম প্রাসাদগুলোর একটি তোপকাপি প্রাসাদ এটি দীর্ঘসময় ওসমানী সালতানাতের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। বলা হয়, তোপকাপি প্রাসাদে এখনো যে পরিমাণ রাজকীয় রত্নপাথর আছে তুরস্ক কোন দিন দেউলিয়া হয়ে গেলে এই প্রাসাদের সম্পদ দিয়ে তুরস্ককে বছর চালানো যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, শত বছরের প্রাচীন এই প্রাসাদ কখনো লুট হয় নি। ফলে সত্যিকার প্রাসাদের সৌন্দর্য এখনো উপভোগ করতে পারে পর্যটকরা।

 

১৪৫৩ সালে ওসমানীরা ইস্তাম্বুল বিজয়ের পর প্রাচীন বাইজেন্টাইন প্রাসাদের স্থানে নির্মাণ করে নতুন তোপকাপি প্রাসাদ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই প্রাসাদে বাস করতো প্রায় হাজার মানুষ। উৎসব আয়োজনে এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যেত ১০ হাজার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রান্নাঘরও রয়েছে এখানে। প্রাসাদে আসা সব মানুষের জন্য এখানে রান্না হতো।

 

বর্তমানে জাদুঘরে রুপান্তর করা হয়েছে এই প্রাসাদকে। তোপকাপি প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে কয়েকটি বিশেষ জাদুঘর। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হলো ইসলামের পবিত্র নিদর্শনের জাদুঘর। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সহ বিভিন্ন নবী রাসূলদের সাহাবীদের ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র রয়েছে এখানে। আরেকটি হলো ওসমানী মেনুস্ক্রিপ্ট জাদুঘর। ওসমানী ইসলামের স্বর্ণযুগের অনেক দুর্লভ পান্ডুলিপি রয়েছে এখানে।

 

১৮৫৬ সালে দোলমাবাহচে প্রাসাদ নির্মাণ হলে রাজপ্রাসাদের মর্যাদা হারায় তোপকাপি। তবে রাজপরিবারের সদস্যরা বাস করতো তোপকাপিতে। ওসমানী সালতানাত উৎখাত করার পর কামাল আতাতুর্ক এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে। 

 

. দোলমাবাহচে প্রাসাদ:

তুরস্কে সবচেয়ে জৌলুসপূর্ণ প্রাসাদ দোলমাবাহচে প্রাসাদ ওসামানী শাসনামলের শেষ যুগে নির্মিত এই প্রাসাদের পেছনে এতো পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে যে বলা হয় এই প্রাসাদ বানিয়ে ওসমানীরা আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। বসফরাসে তীরে ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে এই প্রাসাদের নির্মাণ কাজ চলে। সারা বিশ্বের কাছে ওসমানীদের শান-শওকত তুলে ধরার জন্য নির্মাণ করা হয় এই প্রাসাদ। এই প্রাসাদের নির্মাণ ব্যয় ছিলো ৫০ লক্ষ ওসমানী লিরা বা ৩৫ টন স্বর্ণ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঝাড়বাতি বসানো হয় এখানে। এই প্রাসাদটি ১৮৫৬-১৮৮৭ এবং ১৯০৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত ওসমানী রাজপ্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাসাদটিতে পরে কামাল আতাতুর্ক বাস করতো। দোলমাবাহচেতে প্রবেশ করলে যে কারো চোখ বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে যাবে। অবিকল আগের মতো সাজানো রয়েছে প্রাসাদ। নেই শুধু সেই সুলতান  তাঁর পরিবার।

 

. ইলদিজ প্রাসাদ:

বসফরাসের তীরে হওয়ায় দোলমাবাহচে প্রাসাদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। যেকোন সময় সমুদ্রপথে আক্রমণ করা হতে পারে এই আশংকায় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ নতুন বসফরাস থেকে দূরে বেশিকতাশে একটি পাহাড়ের উপর নিরাপদ স্থানে আরেকটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সেই প্রাসাদের নাম ইলদিজ প্রাসাদ। ১৮৮৭ সালে সুলতান আবদুল হামিদ তার অফিস বাসভবন সরিয়ে নেয় ইলদিজ প্রাসাদে। বিশাল বাগান ঘেরা এই বাড়িতে ছোট ছোট অনেকগুলো ভবন রয়েছে। মাল্টা ম্যানশন, চাদির ম্যানশন, শালে ম্যানশন, অপেরা থিয়েটার ভবন। এছাড়া প্রাসাদের সামনে রয়েছে ইলদিজ জামে মসজিদ। এই মসজিদে সুলতান প্রতি শুক্রবারে জুমা নামাজ পড়তেন এবং জনতার উদ্দেশ্যে সালাম দিতেন। সুলতান আবদুল হামিদকে উৎখাত করতে আসা বিদ্রোহী সেনারা এই প্রাসাদ অবরোধ করে। সুলতানকে বাধ্য করে সিংহাসন ত্যাগ করতে। পরে লুটপাট চলে এই প্রাসাদে। এরদোয়ান পরবর্তীতে ইলদিজ প্রাসাদ সংস্কার করে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের ইস্তাম্বুল অফিস হিসেবে ব্যবহার করছে এই প্রাসাদকে।

 

. বেইলার বে প্রাসাদ:

ইস্তাম্বুলের এশিয়ান সাইডে বসফরাসের তীরে অবস্থিত বেইলার বে প্রাসাদ বেইলার বে মানে গভর্ণর জেনারেল। একসময় এই স্থানে ওসমানী সালতানাতের আনাতোলিয়ার গভর্ণরের বাসভবন ছিলো। পরবর্তীতে সুলতান আবদুল আজিজের শাসনামলে দোলমাবাহচে প্রাসাদের অনুকরণে একই স্থানে সুরম্য এক প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। এই প্রাসাদটি সুলতানের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরে রাষ্ট্রীয় অতিথীদের বাসস্থান হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। সবশেষ সুলতান আবদুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এই প্রাসাদে আমৃত্যু নজরবন্দি করে রাখা হয়। এই প্রাসাদে টি বড় হল রুম ২৬ টি কক্ষ রয়েছে। কক্ষ থেকে বসফরাসের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সোমবার ছাড়া সপ্তাহের দিন সকাল টা থেকে বিকেল টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এই জাদুঘর।

 

এছাড়া ইস্তাম্বুলের উল্লেখযোগ্য প্রাসাদগুলোর মধ্যে রয়েছে চিরাআন প্রাসাদ, ইহলামুর ম্যানশন, মাসলাক ম্যানশন, কুচুক সু  কাসরি, বেইকোজ মেজেদিয়ে কাসরি ওসমানীদের প্রাসাদগুলো দেখলে উপলব্ধি করা যায় একসময় কতটা সমৃদ্ধ ছিল ওসমানী সাম্রাজ্য। আজ আর নেই সে দিনের বহুভাষী, প্রবল প্রতাপশালী সুলতানরা। তাঁদের রেখে যাওয়া কীর্তিগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় হারানো সেই সময়।