দোলমাবাহচে: সোনায় মোড়ানো পতনের প্রাসাদ

dolmabahce istanbul
Dec. 27, 2024

আপনি যদি ইস্তাম্বুল ভ্রমণ করে থাকেন কিন্তু দোলমাবাহচে প্রাসাদ না দেখে থাকেন তাহলে ওসমানী শান-শওকত সৌন্দর্যের ১৫ আনাই আপনার অদেখা রয়ে যাবে।  ওসমানী খেলাফতের শেষ রাজপ্রাসাদ দোলমাবাহচে।

 

বলা হয় যদি কোনদিন তুরস্কের সবগুলো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায় শুধু দোলমাবাহচে প্রাসাদের সম্পদ দিয়ে বছর তুরস্কের সব মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব। কি বিশ্বাস হচ্ছে না?  শুনুন তাহলে এই প্রাসাদের ছাদের শিলিংয়ে ব্যবহার করা হয়েছে ১৪ টন কাঁচা সোনা। প্রাসাদটি তৈরী করতে খরচ হয়েছিল সেসময়কার ৫০ লক্ষ উসমানী স্বর্ণমুদ্রা যা আজকের সময়ে ৩৫ টন স্বর্ণের সমান। এই একটি প্রাসাদ নির্মাণের ব্যয় বহন করতে যেয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল ওসমানী সালতানাত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঝাড়বাতিটি এখানকার বড় হল রুমটিতে শোভা পাচ্ছে। দুই তলা বিশিষ্ট প্রকাণ্ড এই প্রাসাদে রয়েছে ২৮৫ টি কক্ষ, ৪৬ টি হল রুম টি তুর্কিশ বাথ। প্রাসাদের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বিশ্বের সেরা চিত্রশিল্পীদের এনে সুলতানদের তেল রংয়ের ছবি আকানো হয়েছিল। সেই ছবিগুলো এখন শোভা পাচ্ছে প্রাসাদের একটি অংশে। মূল প্রাসাদের একটি অংশে সুলতানের দরবার হল। যেখানে বিদেশী দর্শনার্থীসহ উজীর নাজিররা সুলতানের সাথে দেখা করতেন। আরেকটি অংশে প্রশাসনিক অফিস। সবার শেষে রাজকীয় হারেম।

 

প্রাসাদের ইতিহাসঃ

তরুণ সুলতান আবদুল মজিদের আদেশে ১৮৪৩ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৪০০ বছর ধরে ওসমানীদের ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত তোপকাপি প্রাসাদকে তৎকালীণ ইউরোপীয় রাজপ্রাসাদগুলোর তুলনায় সেকেলে মনে হয় সুলতান আবদুল মজিদের। তাই তিনি সে সময়ের সবচেয়ে আধুনিক সবচেয়ে সুন্দর রাজপ্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। যুদ্ধ বাণিজ্যের ময়দানে ক্রম ক্ষয়িষ্ণু শক্তিকে আড়াল করার আরেকটি ভুল প্রয়াস ছিল এটি। নির্মাণ শুরুর  ১৩ বছর পর ১৮৫৬ সালে প্রাসাদের কাজ শেষ হয়। তবে সাদ্দাদের কথিত বেহেশতের মতো বড় সাধ করে বানানো প্রাসাদের বেশী দিন থাকতে পারেননি সুলতান। মাত্র বছর পর ১৮৬১ সালে টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। পরবর্তী সুলতান আবদুল আজিজ দোলমাবহচে থেকে শাসনাকাজ পরিচালনা করলেও চক্রান্তকারী উজিরদের দ্বারা তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গুপ্ত হত্যার শিকার হন।

 

বিরান প্রাসাদঃ

সালতানাতের দায়িত্ব সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের হাতে আসার পর তিনি ঘরের শত্রু বিভীষণদের উপর চোখ রাখা শুরু করেন। যেহেতু দোলমাবাহচে সমুদ্রের তীরে ছিল সুলতানের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে, সমুদ্র পথে গুপ্তঘাতকের দল সহজে আক্রমণের ছক কষছে। সুলতান দ্রুত নিজের জন্য বসফরাস থেকে অনেক ভেতরে পাহাড়ে উপরে ইলদিজ প্রাসাদ বানিয়ে সেখানে রাজপরিবার প্রশাসনিক অফিস সরিয়ে নেন। ফলে পরবর্তী ৩৩ বছর বিরান পরে থাকে দোলমাবাহচে প্রাসাদ। বছরে মাত্র বার এখানে রাজকীয় অনুষ্ঠান পালন করা হতো। সুলতান আবদুল হামিদের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিদ্রোহী সৈন্যরা লুট করে তার ইলদিজ প্রাসাদ। পরবর্তী সুলতানরা দোলমাবাহচে প্রাসাদকে আবার প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন।

 

কামালের শেষ নি:শ্বাসঃ

১৯২৪ সালে কামাল আতাতুর্ক ওসমানী খিলাফাত উচ্ছেদ করে। কামালের নেতৃত্বে ইতিহাসের পাতা থেকে ওসমানী খিলাফাতের সব স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। কামাল রাজধানী ইস্তাম্বুল থেকে আংকারা সরিয়ে নেয়। কিন্তু দোলমাবাহচে প্রাসাদের মায়া ত্যাগ করতে পারে নি। তাই এটিকে প্রেসিডেন্টের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৩৮ সালে কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুও হয় দোলমাবাহচে প্রাসাদের ভেতরেই। 

 

লুট না হওয়া প্রাসাদঃ

মুসলিম বিশ্বের লুট না হওয়া একটি স্থাপনা যার সবকিছু শত বছর পূর্বের মতো অবিকল রয়ে গেছে। লাল কেল্লা কিংবা আগ্রার রাজপ্রাসাদ থেকে ব্রিটিশরা স্বর্ণগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে নিয়ে গেছে। তাজমহলের যে সৌন্দর্যে সারা বিশ্ব আজ মুগ্ধ তা আসলে তাজমহলের কংকাল। কারন তাজের মহামূল্যবান রত্ন পাথর ইংরেজদের ভোগে চলে গেছে বহু আগে। সব স্বর্ণ, মনিমুক্তা, রত্নপাথরসহ রাজকীয় ঐশ্বর্য ধরে রাখতে সক্ষম রয়েছে শুধু দোলমাবাহচে প্রাসাদ।

 

একবার এখানে প্রবেশ করলে যে কারো মাথা ধরে আসবে। কী প্রকাণ্ড তার হল রুম! কী কারুকাজ তার সিলিংয়ে! কী মোহনীয় আলোকছটা তার শতর্বর্ষী ঝাড়বাতিতে। মনে হবে টাইম মেশিনে চড়ে চলে এসেছেন ওসমানীদের যুগে। সব আছে এখানে। দরবার হল, সুলতানের লাইব্রেরী, রাজমাতার কক্ষ, তার্কিশ বাথ। নেই শুধু সুলতান আর তাঁর সালতানাত।

 

বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর রাজপ্রাসাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দোলমাবাহচে। বসফরাস প্রণালীর কোল ঘেঁষে ৪৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে তৈরী রাজপ্রাসাদের রয়েছে দুটি রাজকীয় গেট। প্রধান ফটকটিই এখন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। প্রাসাদের সামনে রয়েছে সুউচ্চ ক্লক টাওয়ার একটি মসজিদ। প্রাসাদের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে রয়েল গার্ডেন। কৃত্রিম লেকের মাঝখানে ঝর্ণা। প্রাসাদের দেয়াল ঘেঁষে ছোট আরেকটি প্রাসাদ রয়েছে। নাম আয়না প্রাসাদ। কাঁচে ঘেরা এই ঘরে থেকে সুলতান দর্শনার্থীদের সাথে কথা বলত।

 

পরবর্তীতে এটিকে তুরস্ক সরকারের মিল্লি সারাইলার অধিদপ্তরের আওতায় এটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। সপ্তাহে সোম বৃহস্পতিবার বাদে বাকি দিনগুলো দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত এই প্রাসাদ। তবে ভেতরে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ। একা একা ঘুরতে দেয়া হয় না। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত গাইডের সাহায্যে ঘুরে দেখতে পারবেন প্রাসাদটি।

 

কখনো ইস্তাম্বুল আসার সুযোগ হলে অবশ্যই ঘুরে দেখবেন দোলমাবাহচে প্রাসাদ। আপনাদের জন্য বাংলা ভাষায় গাইডসহ সব ধরনের সার্ভিস নিয়ে পাশে আছে অটোমান ট্যুরিজম।