আপনি কি জানেন, আজকের ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া মসজিদ ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। কিভাবে?তৎকালীন কনস্টান্টিনোপল শহরে, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও প্রকাণ্ড গীর্জা আয়াসোফিয়ার ভেতর বাইজেন্টাইন সম্রাটের করোনেশন হতো। মানে আয়া সোফিয়া চার্চের ভেতর তলোয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নতুন সম্রাটের সিংহাসনে অভিষেক সম্পন্ন হতো।
কখনো কি প্রশ্ন জেগেছে তাহলে মহান উসমানী সালতানাতের নতুন সুলতানের অভিষেক কোথায় ও কিভাবে হতো?
আজ সে গল্পই বলছি। বাইজেন্টাইনদের কাছে আয়া সোফিয়া যেমন পবিত্রস্থান। তুর্কি মুসলমানদের কাছে তেমনি পবিত্রস্থান হলো ইস্তাম্বুলের আইয়ুব আনসারী জামে মসজিদ। আইয়ুব আনসারী জামে মসজিদেই ওসমানী সুলতানের অভিষেক অনুষ্ঠান হতো। এই মসজিদের ভেতরেই সালতানাতের প্রথম সুলতান ওসমান গাজীর তলোয়ার তুলে দেয়া হতো নতুন সুলতানের হাতে। ঠিক এই সংস্কৃতির পুনরুত্থান হয়েছে এরদোয়ানের হাতেও। তুরস্ক রাষ্ট্রের ইসলামপন্থী রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান প্রতিটি নির্বাচনে জয় লাভ করার পর শুকরানা নামাজ আদায় করেন এই আইয়ুব সুলতান মসজিদে।
ইস্তাম্বুল বিজয়ের প্রেরণা আইয়ুব আনসারী (রা)। কিন্তু কেন এই মসজিদের এতো মর্যাদা। কারণ এখানে সমাহিত আছেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এর প্রিয়তম সাহাবী হযরত আইয়ুব আনসারী (রা)। এই সাহাবী মুসলমানদের ইস্তাম্বুল বিজয়ের অন্যতম প্রেরণা। সহিহ মুসলিম শরীফের কিতাল আল রুম অধ্যায়ে একটি হাদিস আছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, কনস্টান্টিনোপল শহর জয়ী মুসলিম সেনাদল জান্নাতে যাবে। কনস্টান্টিনোপল ছিল তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ও বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত শহর। হযরত আইয়ুব আনসারী তখন নবীজির পাশেই ছিলেন। তিনি বলেন, প্রিয়নবী আপনি দোয়া করেন আমিও যেন সেই সেনা অভিযানের অংশ হতে পারি। নবীজি বললেন তুমিও সেখানে যাবে।
৬৭০ সালে মুসলিম সেনাবাহিনী যখন কনস্টান্টিনোপল অভিযানে বের হচ্ছে তখন আইয়ুব আনসারী শতবর্ষী বৃদ্ধ। তবুও তিনি বয়সের জীর্ণতাকে অস্বীকার করে আরব থেকে বহুদূরের পথ ইস্তাম্বুলে রওনা হন। কয়েকমাস ইস্তাম্বুল অবরোধ করে রাখে মুসলিম সেনাদল। কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভাঙ্গতে পারে নি মুসলমানরা। অবরোধ তুলে সেবারের মতো দেশে ফিরে যাবে মুসলিম আর্মিরা। সেসময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন আইয়ুব আনসারী। মুসলমানদের প্রধান সেনাপতি ইয়াজিদ বিন মারওয়ান আইয়ুব আনসারীর কাছে জানতে চান আপনার কোন সাহায্য লাগবে কিনা? আইয়ুব আনসারী বলেন, আমার সালাম পৌছে দাও মুসলিম সৈন্যদের নিকট। তাদের বলো প্রবল আক্রমন করে শত্রু ভূখন্ডের যত গভীরে যাওয়া সম্ভব যেতে। আর আমাকে কবর দিও ইস্তাম্বুলের দেয়ালের পাশে। যাতে পরবর্তী কোন সেনাদল ইস্তাম্বুল জয় করতে আসলে আমি যেন তাঁদের ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পাই। মুসলিম সেনারা অভিযান চালিয়ে ইস্তাম্বুল ওয়াল পর্যন্ত পৌছে যায়। ৬৭৪ সালে ইন্তেকাল করেন এই সাহাবী। তার ওসিয়ত অনুযায়ী ইস্তাম্বুল ওয়ালের পাশে তাঁকে কবর দেয়া হয়।
ইস্তাম্বুল বিজয় ও আনসারীর মর্যাদাঃ
আরো ৭৭৯ বছর পর ওসমানী সুলতান মুহাম্মদের নেতৃত্বে মুসলমানরা ইস্তাম্বুল শহর জয় করে। সুলতানের আধ্যাত্বিক গুরু সুফি আকশামউদ্দিন স্বপ্নে দেখেন আইয়ুব আনসারীর কবরের স্থানটি। সেই স্থানের পাশে ১৪৫৮ সালে ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ একটি মাজার, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিশাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করে দেন। পরবর্তীতে অন্যান্য সুলতানরাও এটির সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনে কাজ করেছেন।
তুরস্কের শীর্ষ তীর্থস্থানঃ
আজকের তুরস্কের মুসলমানদের অন্যতম তীর্থস্থান আইয়ুব সুলতান মসজিদ কমপ্লেক্স। দূর-দূরান্ত থেকে মুসলমানরা এই মসজিদে নামাজ পড়তে ও আইয়ুব আনসারীর কবর জিয়ারতে আসেন। রমজানে এখানে ইফতার করতে পরিবার নিয়ে চলে আসেন অনেকে। বাচ্চাদের সুন্নত করানোর পর অনেকে সুলতানদের পোষাক পরিয়ে শিশুদের এখানে নিয়ে আসে। নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেয় ইস্তাম্বুলের আধ্যাত্বিক ইতিহাসের সাথে।
কী কী দেখার আছেঃ
ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল ওয়ালের পাশে ও নৈসর্গিক গোল্ডেন হর্ণের তটে আইয়ুব সুলতান মসজিদ অবস্থিত। মসজিদকে কেন্দ্র করে অনেক দোকানপাট গড়ে ওঠেছে। পাশে রয়েছে একটি রাজকীয় কবরস্থান। আইয়ুব সুলতানের মাজারের পাশে সমাহিত হওয়াকে পরম সৌভাগ্য মনে করা হতো। তাই অনেক অটোমান অভিজাত, যেমন অনেক সুলতান, রাজমাতা, ওসমানী জেনারেলদের কবর রয়েছে এখানে। একটু দূরেই রয়েছে পিয়েরে লোতি ক্যাবলকার। এই ক্যাবলকারে যখন পাহাড়ের উপর থেকে আইয়ুব সুলতানের মাজারে নামবেন চোখে পড়বে পাহাড়ের ঢালে সমাহিত শত সহস্র সাদা কবরের সারি। এক অপার্থিব নীরবতা যেন শত শত বছরের ইতিহাসকে একটি ছবির ফ্রেমে নিয়ে এসেছে। ইস্তাম্বুল শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত গভীর সবুজে ঘেরা আইয়ুব আনসারীর মসজিদ কমপ্লেক্স আপনার হৃদয়ে বয়ে দিবে পবিত্রতার প্রশান্তির পরশ।
ঘুরে আসুন আইয়ুব আল আনসারী কমপ্লেক্সে। নিজস্ব গাড়ী ও অভিজ্ঞ গাইডসহ অটোমান ট্যুরিজম আছে আপনার পাশে।